এক অনলাইন ভিডিও গেম। এর কার্যক্রম অন্য সব অনলাইন গেইমের মতোই। তাই এই গেইমে যখন তরুণ-তরুণীরা খেলতে মত্ত হলো, তখন অভিভাবকদের তেমন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে পারে সেটা মনেই হয়নি। যদিও বিগত বছরগুলোতে অনলাইন গেম রীতিমত মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে অভিভাবকদের মধ্যে। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা বাদ দিয়ে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে বসে গল্প করে সময় কাটাবে তারও কোন লক্ষণ চোখে পড়ে না। খেলাধুলার মাঠে যাওয়া? তো সে দুরস্ত! ঠিকমত ক্লাসে যাচ্ছে না, ক্লাসে অমনোযোগিতা, যথাসময়ে ঘুম থেকে ওঠা, খাওয়া-দাওয়া সবই যেন যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। শুধু অভিভাবকরাই নন, অনলাইন গেমের প্রতি তরুণ প্রজন্মের আসক্তি চিন্তা বাড়িয়েছে মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীদেরও। শিশুদের মনোবিকাশ ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে পরছে। স্বাভাবিক বৃদ্ধিও বাধা পাচ্ছে এই গেমের নেশায়। শুধু কি তাই! অনলাইন গেম খেলতে গিয়ে বিশ্বজুড়ে ঘটে চলেছে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। ব্লু হোয়েল সুইসাইড গেম তেমনি এক অনলাইন গেইম।
সাম্প্রতিককালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে একাধিক দুর্ঘটনা এবং আত্মহত্যার ঘটনায় নাম জড়িয়েছে ‘ব্লু হোয়েল সুইসাইড গেম’ নামের এই সোশ্যাল গেমিং-এর। এক পরিসংখ্যানগত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় যে, গত তিন মাসে রাশিয়া এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় মোট ১৬ জন তরুণী আত্মহত্যা করেছেন।
এতো কম সময়ের মধ্যে এত জন অল্পবয়সী মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনা বিস্মিত করেছিল পুলিশকেও। এদের মধ্যে সাইবেরিয়ার দুই স্কুলছাত্রী য়ুলিয়া কনস্তান্তিনোভা (১৫) এবং ভেরোনিকা ভলকোভা (১৪) একটি বহুতলের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে বলে পুলিশ রিপোর্ট থেকে জানা যায়। তদন্তকারী অফিসারদের তখন মনে হয়েছিল, এই সমস্ত আত্মহনন হয়তো বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়, হয়তো কোনও গোপন যোগসূত্র রয়েছে এদের মধ্যে। মৃত্যুর পূর্বে য়ুলিয়া তার সোশ্যাল পেইজে একটি তিমির ছবি পোস্ট করে লিখে যায় ‘সমাপ্ত’। তদন্তে নেমে পুলিশের নজরে আসে এই ‘ব্লু হোয়েল সুইসাইড গেম’। পুলিশ আরো ধারণা করতে থাকে সারা বিশ্বে অন্তত ১৩০ জন মানুষের আত্মহননের জন্য পরোক্ষে দায়ী এই অনলাইন গেইম।
এই খেলায় মোট ৫০টি আত্মনির্যাতনমূলক পর্যায় সম্পন্ন করতে হতো গেমে প্রতিযোগীদের। অদ্ভুত ও ভয়ঙ্কর ছিল সেই সমস্ত পর্যায়। প্রতিটি পর্যায়ের বিভিন্ন টাস্ক ছিল বেশ ভয়ঙ্কর। গেমের শুরুর টাস্কগুলি অবশ্য তেমন আহামরি কিছু নয়। বরং বেশ মজারই। যেমন, হঠাৎ মাঝরাত্রে ঘুম থেকে উঠে ভূতের সিনেমা দেখা। আর সেইজন্যই খুব সহজেই এই অনলাইন গেমের প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হতে থাকে কিশোর-কিশোরীরা।
কিন্তু ঘটনা ঘটতে থাকে পরবর্তী লেভেলগুলোতে। গেমের লেভেল যত এগোতে থাকে, তত কঠিন এবং ভয়ঙ্কর হতে থাকে টাস্কগুলি। একটি টাস্ক এমন ছিল যে প্রতিযোগীকে নিজের শরীরে ৫০টি নিডল (ইঞ্জেকশনের সূচ) ফুটাতে হবে এবং সেই ছবি পোস্ট করতে হতো গেমিং পেজে। প্রতিযোগিতার একেবারে সর্বশেষ পর্যায়ে ৫০তম টাস্কের কাজ যার পূর্বশর্তই হলো আত্মহনন!
পুলিশের ধারণা, ইদানিংকালে আত্মঘাতী ১৬ জন তরুণীই এই গেমের ৫০তম টাস্কের শর্ত অনুযায়ী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। রাশিয়া পুলিশের আশঙ্কা, সাম্প্রতিককালে গোটা বিশ্বে আত্মঘাতী হওয়া অন্তত ১৩০ জনের আত্মহননের পেছনে রয়েছে এই ‘ব্লু হোয়েল সুইসাইড গেম’।
আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে রাশিয়ার পুলিশ জানায়, য়ুলিয়া এবং ভেরোনিকাসহ আত্মহত ১৬ তরুণীই সুইসাইড গেম-এ আসক্ত ছিল। তারা একেকজন ছিল নিষ্ঠাবান খেলোয়াড়। প্রায় উন্মাদনার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল তাদের জীবনে এই খেলা। খেলায় নিজেকে জয়ী দেখতে চাওয়ার নেশায় তারা নিজেকে শেষ করে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করেনি। প্রত্যেকে প্রতিযোগীই খেলার ৫০তম লেভেল পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। এই ৫০তম লেভেলেই প্রতিযোগীকে আত্মহত্যা করতে হয়। আর এভাবেই এসব তরুণী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
তদন্তে পুলিশ আরও জানতে পারে, এই গেমিংয়ের জন্য যে মোবাইল অ্যাপ রয়েছে তা কেউ একবার ডাউনলোড করলে তা আর সহজেই ডিলিট করা সম্ভব হয় না। শুধু কি তাই! একের পর এক মোবাইলে ক্রমাগত আসতে থাকে নোটিফিকেশন। ফলে ইচ্ছে না করলেও ওই মোবাইলের ইউজার এই গেম খেলতে বাধ্য হন।
তদন্তে নেমে পুলিশ হন্যে হয়ে খুজতে থাকে ফিলিপকে। কিন্তু সকলের প্রশ্ন জাগে কিন্তু কে এই ফিলিপ? কেনই বা তার জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন তরুণ-তরুণীরা? রাশিয়ার পুলিশ প্রাপ্ত সূত্র হতে জানা যায়, ২১ বছর বয়সী ফিলিপ ছিল রাশিয়ারই একজন বাসিন্দা। সে ভিকোন্তাক্তে নামক সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ব্লু হোয়েল সুইসাইড গেম’ নামের এই সোশ্যাল গেমিংটির পেজের অ্যাডমিন ছিল। স্বভাবতই, পুলিশের সন্দেহ গিয়ে পরে তার উপর। শেষমেশ বেশ কিছুদিন তদন্ত চালিয়ে ফিলিপ-কে গ্রেফতার করে পুলিশ।
পুলিশের তীব্র জেরায় এই গেম চালানোর কথা স্বীকারও করে নেয় ফিলিপ। কিন্তু সে এইসব মৃত্যুর দায় নিতে অস্বীকার করে। সে কোনোভাবেই তার এই অনলাইন গেমকে অপরাধ বলে মানতে রাজি নন। তার বক্তব্য, সে তার খেলার মধ্য দিয়ে সমাজের ‘শুদ্ধিকরণ’ করছে। সে গর্বের সাথে বলতে থাকে, সমাজে যাদের বেঁচে থাকা উচিত নয়, তাদেরকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়াই ছিল তার লক্ষ্য। ফিলিপের মুখে এই সমস্ত কথা শুনে তার মানসিক সুস্থতা নিয়েই সন্দেহ জাগে পুলিশের মনে। ফিলিপ বর্তমানে সেন্ট পিটার্সবার্গের ক্রিস্টি জেলে বন্দী।
অ্যাডমিন গ্রেফতার হলেই সোশ্যাল মিডিয়ার একটি পেজ বন্ধ হয়ে যায় না। ফিলিপকে বন্দী করা গেলেও তার পেজের কার্যক্রম থেমে থাকেনি এবং পেজটি বন্ধও হয়নি। ফলে পেজটি নিয়ে পুলিশের মনে চিন্তার রেখা থেকেই যাচ্ছে। বর্তমানে ‘ব্লু হোয়েল সুইসাইড গেম’টি রাশিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে ব্রিটেনের তরুণ-তরুণীদের মধ্যেও দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এর ফলে চিন্তা বাড়ছে ইউরোপের একাধিক মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীদের। স্কুল কলেজ থেকে প্রচারণা চালানো হচ্ছে এবং অভিভাবকদের সর্তক করে দেয়া হচ্ছে যেন তারা তাদের সন্তানদের এই গেম থেকে দূরে রাখে। তাই সুইসাইড গেমের এই পেজটিকে নিষিদ্ধ করার কথাই ভাবছে পুলিশ-প্রশাসন।
সবকিছুই কেমন অদ্ভুত মনে হয় না? একটা সাধারণ গেম কীভাবে উচ্ছল কিশোরীর জীবন কেড়ে নিচ্ছে! মনোবিশেষজ্ঞরাও বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। কেন একটা গেমের কারণে এতগুলো ছেলে মেয়ে আত্মহত্যা করছে তা খুবই উদ্বেগজনক । বিষয়টির গভীরে অনুসন্ধানের জন্য রাজনীতিবিদদের তারা বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন। জীবনের ব্যস্ততায় আমরা কমবেশি সকলেই একটু একটু করে মনোবেদনায় আক্রান্ত হচ্ছি, তা না হলে আমাদের মধ্যকার সোশ্যাল ভেল্যুগুলো কেন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে? কেন আমরা আর সুখে, দুঃখে, আনন্দ, বেদনায় নিজেকে আর আন্দোলিত করতে পারি না? পরিবারের বা সমাজের সকলের মাঝের বন্ধন কেন আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে যাচ্ছে? এসবই কি প্ররোচনা যোগাচ্ছে এমন গেম খেলতে? এবার হয়তো সবার ভাবার সময় এসেছে।
তথ্যসূত্রঃ
১) https://www.thesun.co.uk/news/worldnews/blue-whale-suicide-game-online-victims/
২) http://www.dailymail.co.uk/news/Blue-Whale-game-mastermind-says-s-cleansing-society.html
১) https://www.thesun.co.uk/news/worldnews/blue-whale-suicide-game-online-victims/
২) http://www.dailymail.co.uk/news/Blue-Whale-game-mastermind-says-s-cleansing-society.html