তথ্য-প্রযুক্তি বিপ্লবের একজন স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে তাঁর অবদান বিশ্ববাসী শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে সবসময়। আরেকটি কারণে অমর হয়ে থাকবেন তিনি চিরদিন। সেটি একটি অসামান্য বক্তৃতার জন্য। ২০০৫ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এ বক্তৃতা দেন তিনি। পৃথিবীজুড়ে লাখো মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এ বক্তৃতাটি পাঠকদের জন্য ভাবানুবাদ করা হলো ঃ
আজ তোমাদের সামনে হাজির হতে পেরে বড় গৌরব হচ্ছে আমার! পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর একটির ছাত্র
তোমরা। মজার ব্যাপার হলো আমি নিজে কখনো কলেজের পাটও চুকোতে পারিনি! আজ এই আনন্দের দিনে কোন জ্ঞানগর্ভ
বক্তৃতা দেওয়ার ইচ্ছা নেই আমার। কেবল তিনটা গল্প শেয়ার করতে চাই তোমাদের সাথে। আমার জীবনের তিনটি গল্প। ব্যাস, এটুকুই।
প্রথম গল্পটা হচ্ছে জীবনটাকে এক সুতোয় বাঁধা নিয়েঃ
আমি রীড কলেজে ভর্তি হওয়ার মাত্র ছয় মাসের মধ্যে ড্রপ আউট হয়ে যাই! কিন্তু দেখা গেল তারপর আরো প্রায় বছর দেড়েক
সেখানে থেকে গেলাম সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে আসবার আগে। প্রশ্ন হচ্ছে, এত সাধের একটা কলেজ থেকে কেন ড্রপ আউট হলাম আমি?
এই গল্পের শুরু আসলে আমার জন্মেরও আগে। আমার মা ছিলেন কলেজে পড়ুয়া কমবয়সী একটি মেয়ে। আমাকে লালন পালন
করার মত অবস্থা তার ছিল না। তিনি ঠিক করলেন আমাকে কারো কাছে দত্তক দিয়ে দেবেন। মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল আমার দত্তক
পরিবার হবে উচ্চশিক্ষিত, নিদেনপক্ষে কলেজ গ্র্যাজুয়েট।
সেভাবেই সব ঠিকঠাক, এক আইনজীবী পরিবারের সাথে দফা হলো আমাকে দত্তক নেওয়ার। সমস্যা বাঁধলো ঠিক আমার জন্মের সময়।
শেষ মুহূর্তে সেই দম্পতি ভেবে দেখলেন তারা আসলে একটা কন্যাশিশু চান! তখন ওয়েটিং লিস্ট থেকে ফোন গেল আরেক দম্পতির কাছে।
“আমাদের কাছে একটি ছেলেশিশু এসেছে। আপনারা কি তাকে দত্তক নিতে আগ্রহী?”
“অবশ্যই!”
এভাবেই আমার নতুন বাবা মার কোলে চলে গেলাম আমি। কিন্তু আমার মা কিভাবে যেন খবর পেয়ে গেলেন এই নতুন বাবা মা
কেউই আসলে কলেজের দোরগোড়া পেরোন নি! মা তো রেগে কাঁই! অবশেষে তাকে বহুকষ্টে ঠান্ডা করা গেলো এই শর্তে যে
একদিন আমাকে অবশ্যই কলেজে পাঠানো হবে!
আমার নতুন বাবা মা তাদের কথা রাখলেন। সেদিনের সেই ছোট্ট আমি সতের বছর পর সত্যি সত্যি কলেজে পা রাখলাম!
কিন্তু বোকার মত এত খরুচে একটা কলেজ বেছে নিলাম যে বেচারী বাবা মার সারা জীবনের সঞ্চয় জলের মত খরচ হতে লাগলো আমার
পিছনে! এভাবে ছয় মাস চলার পর ভেবে দেখলাম ভুল সবই ভুল। আমি যে আসলে জীবনে কি করতে চাই সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।
কলেজের পড়ালেখা বিরাট যন্ত্রণা, এই আপদ বয়ে বেড়ানোর কোন মানে দেখলাম না। হুট করে সিদ্ধান্ত নিলাম ড্রপ আউট হয়ে যাই!
ঠান্ডা মাথায় ভাবতে গেলে নিজেকে বেকুব মনে হওয়ার কথা। কিন্তু আমার কেন যেন অনুভব হলো একদম ঠিক কাজ করেছি! মন যদি
নাই টেকে কেন তবে ঝুলে থেকে খামাখা নিজেকে কষ্ট দেওয়া?!
সুতরাং কয়দিন পর দেখা গেল আমি মহানন্দে ক্লাস করা ছেড়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি ক্যাম্পাসে! বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে ঘুরাঘুরি করি, যখন যেই
ক্লাস ইন্টারেস্টিং লাগে সেখানে ঢুঁ মেরে আসি।
ব্যাপারটা কাগজে কলমে খুব বিপ্লবী শোনাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে রোমান্টিসিজমের ছিঁটেফোঁটাও ছিল না! যেহেতু আমি আর ছাত্র না, সুতরাং কোন
রুম পেলাম না। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে রাতে বন্ধুদের রুমের মেঝেতে মরার মত ঘুমাই। পকেটে কোন পয়সা নাই, কাউকে
কিছু বলতেও পারি না লজ্জায়। ক্ষিধেয় চোখে অন্ধকার দেখি। কোকের বোতল কুড়িয়ে ফেরত দিলে পাঁচ সেন্ট করে দেয়, আমি এই কাজ
করে খাওয়ার খরচ জোটানো শুরু দিলাম। প্রতি রবিবার সাত মাইল হেঁটে হরে কৃষ্ণ মন্দিরে যেতাম, সেখানে মুফতে বড় ভাল খাবার মিলতো সেদিন!
মজার ব্যাপার হলো এত দুঃখ কষ্টের মাঝেও আমার কোন আফসোস ছিল না। এই ভবঘুরে জীবন নিয়ে বেশ ছিলাম। যখন যেটাতে আগ্রহ পাই
সেটা নিয়ে লেগে থাকি। ব্যাপারটা যে কত সুদূরপ্রসারী ছিল তার একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই-
কলেজে হঠাত একবার ক্যালিগ্রাফি কোর্স চালু হলো। ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টারে, ড্রয়ারের লেবেল পর্যন্ত অসম্ভব সুন্দর ক্যালিগ্রাফি
দিয়ে সাজানো। আমি বড় মুগ্ধ হলাম দেখে। যেহেতু কোন কাজ নেই, ভর্তি হলাম ক্যালিগ্রাফি কোর্সে। সারাদিন এটা নিয়েই পড়ে থাকি।
টাইপোগ্রাফির যত খুঁটিনাটি, বিভিন্ন রকম ফন্ট, কালির ব্যবহার আরো কত কী শিখলাম। আমি বিজ্ঞানের মানুষ, শিল্পের এই প্রগাঢ় সৌন্দর্যের
জগৎ আমাকে বিমোহিত করলো। শিল্পের প্রতি আমার জন্ম নিল গভীর আবেগ।
এই তুচ্ছ ক্যালিগ্রাফি কোর্স আমার জীবনে কোন কাজে লাগার কথা না। (যদি না আমি পোস্টারে লেখালেখির কাজ করে জীবন চালানোর কথা ভাবি!)
কিন্তু বছর দশেক পর একটা দারুণ ব্যাপার ঘটলো! আমরা যখন প্রথম ম্যাক কম্পিউটার ডিজাইন করছিলাম, তখন আমার মনে ভীড় করলো
সেই কলেজ জীবনে ক্লাস বাদ দিয়ে শেখা ক্যালিগ্রাফি কোর্সের কথা। দেখা গেল এতদিন পরেও কিছুই ভুলিনি, সব ঠিকঠাক মনে আছে! আমরা
পরম মমতায় ম্যাক কম্পিউটারকে সাজালাম অসম্ভব সুন্দর সব টাইপোগ্রাফি দিয়ে।
একবার ভেবে দেখো তো, আমি যদি সেদিন ড্রপ আউট হয়ে এই ক্যালিগ্রাফি না শিখতাম, তাহলে ম্যাক কম্পিউটারে আগের খটোমটো
ডিজাইনই থেকে যেতো। আর উইন্ডোজও যেহেতু আমাদের ডিজাইন চোখ বুঁজে মেরে দিয়েছে (!), সুতরাং বলাই যায়, সেদিনের সেই পাগলামিটা
না করলে আজ পৃথিবীর কোথাও কম্পিউটারে এমন মন জুড়ানো টাইপোগ্রাফি হয়তো থাকতো না!
আমি যখন ক্যালিগ্রাফি শিখলাম, তখন কি আদৌ জানতাম আমার এই জ্ঞান একদিন পৃথিবী বদলে দেবে? এটাই হচ্ছে জীবনের আনন্দ।
তুমি যখন কিছু শেখো, নতুন কিছু করো, ক্লাসের পড়ালেখার বাইরেও বিভিন্ন কাজে অংশ নাও, মনে হতে পারে এসব করে কী হবে?!
কিন্তু দশ বছর পর যখন স্মৃতির পাতা উল্টাবে, তখন দেখবে এই টুকরো টুকরো পরিশ্রমগুলোর কি সুন্দর এক সুতোয় বাঁধুনি হয়েছে তোমার
জীবনে! সুতরাং তুমি যাই কিছু করো না কেন, বিশ্বাস রেখো সবসময় নিজের উপর। একদিন তারায় তারায় রটিয়ে দেবে তোমার গল্প, এই অসম্ভব
দৃঢ় বিশ্বাসটাই দেখবে বদলে দেবে জীবন চিরদিনের জন্য!
আমার দ্বিতীয় গল্পটা ভালবাসা নিয়ে। ভালবাসবার এবং হারাবার ঃ
নেশা আর পেশা যার মিলে যায় সে বড় ভাগ্যবান। আমি খুব কম বয়সেই আমার ভালবাসার জায়গাটা খুঁজে পেয়েছিলাম। ওজ এবং
আমি যখন বাসার গ্যারেজে অ্যাপলের যাত্রা শুরু দিলাম তখন আমার বয়স মাত্র বিশ! রাতদিন উন্মাদের মত খাটতাম আমরা। দেখা গেল
মাত্র দশ বছরের মাথায় সেই গ্যারেজের ঘুঁপচিতে জন্ম নেওয়া অ্যাপল এখন দুই বিলিয়ন ডলারের বিশাল এক প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে
চার হাজারেরও বেশি মানুষ কাজ করে! আমার তিরিশতম জন্মদিনের কয়দিন পরই বাজারে আসলো অ্যাপলের কালজয়ী উদ্ভাবন- দ্যা ম্যাকিন্টশ।
এবং তারপর পরই আমাকে অ্যাপল থেকে বের করে দেওয়া হলো!
কি আজব কান্ড! নিজের হাতে তৈরি করা একটা প্রতিষ্ঠান থেকে কিভাবে কেউ তোমাকে বের করে দেয়? ঘটনা হচ্ছে অ্যাপল যখন বড় হতে
লাগলো, তখন এই বিপুল কাজের চাপ সামলানোর জন্য আমরা একজন চৌকস লোককে এনেছিলাম। কয়দিন পর দেখা গেল তার সাথে আমার
চিন্তাভাবনা মিলছে না। অ্যাপলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার আর আমার পরিকল্পনায় আকাশ-পাতাল ফারাক! তখন দুজনের মাঝে বেশ ধুন্ধুমার
কান্ড বেঁধে গেল, এবং অ্যাপলের পরিচালনা পর্ষদের সবাই গম্ভীর মুখে জানিয়ে দিলো তাদের সমর্থন ওর সাথেই আছে! সুতরাং মাত্র তিরিশ
বছর বয়সে আমাকে নিজের হাতে তিল তিল করে গড়ে তোলা কোম্পানি থেকে রীতিমত ঢাকঢোল বাজিয়ে বের করে দেওয়া হলো! সারা জীবনের
ভালবাসা আর সাধনা এক ফুঁৎকারে উড়ে গেল বাতাসে। আমার বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল কষ্টে।
এরপর বেশ কিছুদিন আমি দিশেহারার মত ঘুরে বেড়ালাম। ভেতরটা একদম এলোমেলো লাগছিলো। একবার ভাবলাম সব ছেড়েছুড়ে
নিরুদ্দেশ হয়ে যাই! কিন্তু এত দুঃখের মাঝেও একটা জিনিস অনুভব করলাম- আমার ভালবাসাটা হারিয়ে যায়নি!
অ্যাপল থেকে অপমানিত হয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছে আমাকে, সবার কাছে ব্যর্থতার প্রতীক এই স্টিভ জবস, কিন্তু তাতে আমার
ভালবাসার নক্ষত্র এতটুকু ম্লান হয়নি! আমি ঠিক করলাম সবকিছু নতুন করে শুরু করবো।
প্রকৃতির এই এক লীলাখেলা। অ্যাপল থেকে ছাঁটাই হওয়ার পর আমার মনে হচ্ছিল লজ্জায় মাটিতে মিশে যাই! কিন্তু পিছন ফিরে তাকালে
মনে হয়- আরে! এর থেকে চমৎকার আর কিইবা হতে পারতো জীবনে! সাফল্যের একটা বিশাল ভার আছে। হাজারো প্রত্যাশা আর দম্ভ
বুকের মাঝে পাথর হয়ে চেপে বসে। সবসময় একটা গন্ডির ভিতর চলতে হয়, চাইলেই যা ইচ্ছা করা যায় না। কিন্তু আমি যেহেতু সবকিছু
একদম নতুন করে শুরু করছি, আমার এরকম কোন ঝামেলা নেই! যা ইচ্ছা, যেমন খুশি তেমন চলার আনন্দে বিভোর আমি প্রত্যাশার শিকল
ভেঙ্গে ডুব দিলাম সৃজনশীলতার এক অপূর্ব জগতে!
পরের পাঁচ বছরে আমি “নেক্সট” নামে একটা কোম্পানি খুললাম। তারপর “পিক্সার” নামে আরো একটা, এবং প্রেমে পড়লাম
অসাধারণ এক রমণীর, বিয়ে করে ফেললাম দুজনে! এই পিক্সার থেকেই আমরা বের করলাম পৃথিবীর প্রথম কম্পিউটার এনিমেটেড
ফিল্ম “টয় স্টোরি”। এখন তো পিক্সার পৃথিবীর সবচেয়ে সফল এনিমেশন স্টুডিও!
আজ তোমাদের সামনে হাজির হতে পেরে বড় গৌরব হচ্ছে আমার! পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর একটির ছাত্র
তোমরা। মজার ব্যাপার হলো আমি নিজে কখনো কলেজের পাটও চুকোতে পারিনি! আজ এই আনন্দের দিনে কোন জ্ঞানগর্ভ
বক্তৃতা দেওয়ার ইচ্ছা নেই আমার। কেবল তিনটা গল্প শেয়ার করতে চাই তোমাদের সাথে। আমার জীবনের তিনটি গল্প। ব্যাস, এটুকুই।
প্রথম গল্পটা হচ্ছে জীবনটাকে এক সুতোয় বাঁধা নিয়েঃ
আমি রীড কলেজে ভর্তি হওয়ার মাত্র ছয় মাসের মধ্যে ড্রপ আউট হয়ে যাই! কিন্তু দেখা গেল তারপর আরো প্রায় বছর দেড়েক
সেখানে থেকে গেলাম সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে আসবার আগে। প্রশ্ন হচ্ছে, এত সাধের একটা কলেজ থেকে কেন ড্রপ আউট হলাম আমি?
এই গল্পের শুরু আসলে আমার জন্মেরও আগে। আমার মা ছিলেন কলেজে পড়ুয়া কমবয়সী একটি মেয়ে। আমাকে লালন পালন
করার মত অবস্থা তার ছিল না। তিনি ঠিক করলেন আমাকে কারো কাছে দত্তক দিয়ে দেবেন। মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল আমার দত্তক
পরিবার হবে উচ্চশিক্ষিত, নিদেনপক্ষে কলেজ গ্র্যাজুয়েট।
সেভাবেই সব ঠিকঠাক, এক আইনজীবী পরিবারের সাথে দফা হলো আমাকে দত্তক নেওয়ার। সমস্যা বাঁধলো ঠিক আমার জন্মের সময়।
শেষ মুহূর্তে সেই দম্পতি ভেবে দেখলেন তারা আসলে একটা কন্যাশিশু চান! তখন ওয়েটিং লিস্ট থেকে ফোন গেল আরেক দম্পতির কাছে।
“আমাদের কাছে একটি ছেলেশিশু এসেছে। আপনারা কি তাকে দত্তক নিতে আগ্রহী?”
“অবশ্যই!”
এভাবেই আমার নতুন বাবা মার কোলে চলে গেলাম আমি। কিন্তু আমার মা কিভাবে যেন খবর পেয়ে গেলেন এই নতুন বাবা মা
কেউই আসলে কলেজের দোরগোড়া পেরোন নি! মা তো রেগে কাঁই! অবশেষে তাকে বহুকষ্টে ঠান্ডা করা গেলো এই শর্তে যে
একদিন আমাকে অবশ্যই কলেজে পাঠানো হবে!
আমার নতুন বাবা মা তাদের কথা রাখলেন। সেদিনের সেই ছোট্ট আমি সতের বছর পর সত্যি সত্যি কলেজে পা রাখলাম!
কিন্তু বোকার মত এত খরুচে একটা কলেজ বেছে নিলাম যে বেচারী বাবা মার সারা জীবনের সঞ্চয় জলের মত খরচ হতে লাগলো আমার
পিছনে! এভাবে ছয় মাস চলার পর ভেবে দেখলাম ভুল সবই ভুল। আমি যে আসলে জীবনে কি করতে চাই সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।
কলেজের পড়ালেখা বিরাট যন্ত্রণা, এই আপদ বয়ে বেড়ানোর কোন মানে দেখলাম না। হুট করে সিদ্ধান্ত নিলাম ড্রপ আউট হয়ে যাই!
ঠান্ডা মাথায় ভাবতে গেলে নিজেকে বেকুব মনে হওয়ার কথা। কিন্তু আমার কেন যেন অনুভব হলো একদম ঠিক কাজ করেছি! মন যদি
নাই টেকে কেন তবে ঝুলে থেকে খামাখা নিজেকে কষ্ট দেওয়া?!
সুতরাং কয়দিন পর দেখা গেল আমি মহানন্দে ক্লাস করা ছেড়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি ক্যাম্পাসে! বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে ঘুরাঘুরি করি, যখন যেই
ক্লাস ইন্টারেস্টিং লাগে সেখানে ঢুঁ মেরে আসি।
ব্যাপারটা কাগজে কলমে খুব বিপ্লবী শোনাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে রোমান্টিসিজমের ছিঁটেফোঁটাও ছিল না! যেহেতু আমি আর ছাত্র না, সুতরাং কোন
রুম পেলাম না। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে রাতে বন্ধুদের রুমের মেঝেতে মরার মত ঘুমাই। পকেটে কোন পয়সা নাই, কাউকে
কিছু বলতেও পারি না লজ্জায়। ক্ষিধেয় চোখে অন্ধকার দেখি। কোকের বোতল কুড়িয়ে ফেরত দিলে পাঁচ সেন্ট করে দেয়, আমি এই কাজ
করে খাওয়ার খরচ জোটানো শুরু দিলাম। প্রতি রবিবার সাত মাইল হেঁটে হরে কৃষ্ণ মন্দিরে যেতাম, সেখানে মুফতে বড় ভাল খাবার মিলতো সেদিন!
মজার ব্যাপার হলো এত দুঃখ কষ্টের মাঝেও আমার কোন আফসোস ছিল না। এই ভবঘুরে জীবন নিয়ে বেশ ছিলাম। যখন যেটাতে আগ্রহ পাই
সেটা নিয়ে লেগে থাকি। ব্যাপারটা যে কত সুদূরপ্রসারী ছিল তার একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই-
কলেজে হঠাত একবার ক্যালিগ্রাফি কোর্স চালু হলো। ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টারে, ড্রয়ারের লেবেল পর্যন্ত অসম্ভব সুন্দর ক্যালিগ্রাফি
দিয়ে সাজানো। আমি বড় মুগ্ধ হলাম দেখে। যেহেতু কোন কাজ নেই, ভর্তি হলাম ক্যালিগ্রাফি কোর্সে। সারাদিন এটা নিয়েই পড়ে থাকি।
টাইপোগ্রাফির যত খুঁটিনাটি, বিভিন্ন রকম ফন্ট, কালির ব্যবহার আরো কত কী শিখলাম। আমি বিজ্ঞানের মানুষ, শিল্পের এই প্রগাঢ় সৌন্দর্যের
জগৎ আমাকে বিমোহিত করলো। শিল্পের প্রতি আমার জন্ম নিল গভীর আবেগ।
এই তুচ্ছ ক্যালিগ্রাফি কোর্স আমার জীবনে কোন কাজে লাগার কথা না। (যদি না আমি পোস্টারে লেখালেখির কাজ করে জীবন চালানোর কথা ভাবি!)
কিন্তু বছর দশেক পর একটা দারুণ ব্যাপার ঘটলো! আমরা যখন প্রথম ম্যাক কম্পিউটার ডিজাইন করছিলাম, তখন আমার মনে ভীড় করলো
সেই কলেজ জীবনে ক্লাস বাদ দিয়ে শেখা ক্যালিগ্রাফি কোর্সের কথা। দেখা গেল এতদিন পরেও কিছুই ভুলিনি, সব ঠিকঠাক মনে আছে! আমরা
পরম মমতায় ম্যাক কম্পিউটারকে সাজালাম অসম্ভব সুন্দর সব টাইপোগ্রাফি দিয়ে।
একবার ভেবে দেখো তো, আমি যদি সেদিন ড্রপ আউট হয়ে এই ক্যালিগ্রাফি না শিখতাম, তাহলে ম্যাক কম্পিউটারে আগের খটোমটো
ডিজাইনই থেকে যেতো। আর উইন্ডোজও যেহেতু আমাদের ডিজাইন চোখ বুঁজে মেরে দিয়েছে (!), সুতরাং বলাই যায়, সেদিনের সেই পাগলামিটা
না করলে আজ পৃথিবীর কোথাও কম্পিউটারে এমন মন জুড়ানো টাইপোগ্রাফি হয়তো থাকতো না!
আমি যখন ক্যালিগ্রাফি শিখলাম, তখন কি আদৌ জানতাম আমার এই জ্ঞান একদিন পৃথিবী বদলে দেবে? এটাই হচ্ছে জীবনের আনন্দ।
তুমি যখন কিছু শেখো, নতুন কিছু করো, ক্লাসের পড়ালেখার বাইরেও বিভিন্ন কাজে অংশ নাও, মনে হতে পারে এসব করে কী হবে?!
কিন্তু দশ বছর পর যখন স্মৃতির পাতা উল্টাবে, তখন দেখবে এই টুকরো টুকরো পরিশ্রমগুলোর কি সুন্দর এক সুতোয় বাঁধুনি হয়েছে তোমার
জীবনে! সুতরাং তুমি যাই কিছু করো না কেন, বিশ্বাস রেখো সবসময় নিজের উপর। একদিন তারায় তারায় রটিয়ে দেবে তোমার গল্প, এই অসম্ভব
দৃঢ় বিশ্বাসটাই দেখবে বদলে দেবে জীবন চিরদিনের জন্য!
আমার দ্বিতীয় গল্পটা ভালবাসা নিয়ে। ভালবাসবার এবং হারাবার ঃ
নেশা আর পেশা যার মিলে যায় সে বড় ভাগ্যবান। আমি খুব কম বয়সেই আমার ভালবাসার জায়গাটা খুঁজে পেয়েছিলাম। ওজ এবং
আমি যখন বাসার গ্যারেজে অ্যাপলের যাত্রা শুরু দিলাম তখন আমার বয়স মাত্র বিশ! রাতদিন উন্মাদের মত খাটতাম আমরা। দেখা গেল
মাত্র দশ বছরের মাথায় সেই গ্যারেজের ঘুঁপচিতে জন্ম নেওয়া অ্যাপল এখন দুই বিলিয়ন ডলারের বিশাল এক প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে
চার হাজারেরও বেশি মানুষ কাজ করে! আমার তিরিশতম জন্মদিনের কয়দিন পরই বাজারে আসলো অ্যাপলের কালজয়ী উদ্ভাবন- দ্যা ম্যাকিন্টশ।
এবং তারপর পরই আমাকে অ্যাপল থেকে বের করে দেওয়া হলো!
কি আজব কান্ড! নিজের হাতে তৈরি করা একটা প্রতিষ্ঠান থেকে কিভাবে কেউ তোমাকে বের করে দেয়? ঘটনা হচ্ছে অ্যাপল যখন বড় হতে
লাগলো, তখন এই বিপুল কাজের চাপ সামলানোর জন্য আমরা একজন চৌকস লোককে এনেছিলাম। কয়দিন পর দেখা গেল তার সাথে আমার
চিন্তাভাবনা মিলছে না। অ্যাপলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার আর আমার পরিকল্পনায় আকাশ-পাতাল ফারাক! তখন দুজনের মাঝে বেশ ধুন্ধুমার
কান্ড বেঁধে গেল, এবং অ্যাপলের পরিচালনা পর্ষদের সবাই গম্ভীর মুখে জানিয়ে দিলো তাদের সমর্থন ওর সাথেই আছে! সুতরাং মাত্র তিরিশ
বছর বয়সে আমাকে নিজের হাতে তিল তিল করে গড়ে তোলা কোম্পানি থেকে রীতিমত ঢাকঢোল বাজিয়ে বের করে দেওয়া হলো! সারা জীবনের
ভালবাসা আর সাধনা এক ফুঁৎকারে উড়ে গেল বাতাসে। আমার বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল কষ্টে।
এরপর বেশ কিছুদিন আমি দিশেহারার মত ঘুরে বেড়ালাম। ভেতরটা একদম এলোমেলো লাগছিলো। একবার ভাবলাম সব ছেড়েছুড়ে
নিরুদ্দেশ হয়ে যাই! কিন্তু এত দুঃখের মাঝেও একটা জিনিস অনুভব করলাম- আমার ভালবাসাটা হারিয়ে যায়নি!
অ্যাপল থেকে অপমানিত হয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছে আমাকে, সবার কাছে ব্যর্থতার প্রতীক এই স্টিভ জবস, কিন্তু তাতে আমার
ভালবাসার নক্ষত্র এতটুকু ম্লান হয়নি! আমি ঠিক করলাম সবকিছু নতুন করে শুরু করবো।
প্রকৃতির এই এক লীলাখেলা। অ্যাপল থেকে ছাঁটাই হওয়ার পর আমার মনে হচ্ছিল লজ্জায় মাটিতে মিশে যাই! কিন্তু পিছন ফিরে তাকালে
মনে হয়- আরে! এর থেকে চমৎকার আর কিইবা হতে পারতো জীবনে! সাফল্যের একটা বিশাল ভার আছে। হাজারো প্রত্যাশা আর দম্ভ
বুকের মাঝে পাথর হয়ে চেপে বসে। সবসময় একটা গন্ডির ভিতর চলতে হয়, চাইলেই যা ইচ্ছা করা যায় না। কিন্তু আমি যেহেতু সবকিছু
একদম নতুন করে শুরু করছি, আমার এরকম কোন ঝামেলা নেই! যা ইচ্ছা, যেমন খুশি তেমন চলার আনন্দে বিভোর আমি প্রত্যাশার শিকল
ভেঙ্গে ডুব দিলাম সৃজনশীলতার এক অপূর্ব জগতে!
পরের পাঁচ বছরে আমি “নেক্সট” নামে একটা কোম্পানি খুললাম। তারপর “পিক্সার” নামে আরো একটা, এবং প্রেমে পড়লাম
অসাধারণ এক রমণীর, বিয়ে করে ফেললাম দুজনে! এই পিক্সার থেকেই আমরা বের করলাম পৃথিবীর প্রথম কম্পিউটার এনিমেটেড
ফিল্ম “টয় স্টোরি”। এখন তো পিক্সার পৃথিবীর সবচেয়ে সফল এনিমেশন স্টুডিও!
সংগৃহীত -