জেএসসি ও এসএসসি কোনোটাতেই জিপিএ ৫ জোটেনি উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র আহমেদ নাফিস ফারহানের। তবে থামেনি তার বিজয় রথ। বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ তাকে এনে দিয়েছে দেশি-বিদেশি অনেক পুরস্কার।
আগামী ডিসেম্বরেই নেদারল্যান্ডসে হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াড। বাংলাদেশ দলে নাফিসও আছে। গত বছর ইন্দোনেশিয়ায় হয়ে যাওয়া এ উৎসবেও সে গিয়েছিল। বাকি পাঁচজনের মতো সে-ও এনেছিল ব্রোঞ্জ পদক।
বড় হয়ে অনেকেই হতে চায় মা-বাবার মতো। নাফিসও ব্যতিক্রম নয়। ছোটবেলা থেকেই কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় প্রকৌশলী বাবার কাজকর্ম। বাবার অফিসে নানা যন্ত্রপাতি দেখে অবাক হতো। তখনই যন্ত্রের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। ফেলে দেওয়া এটা-ওটা দিয়ে বানিয়ে ফেলত মজার কিছু। সিনেমায় তার প্রিয় চরিত্র আয়রনম্যান।
হতে চায় টনি স্টার্কের মতোই। আপাতত হাতের ইশারায় বাতি অন-অফ করতে নিজের মতো করে একটা নকশা সে বানিয়েছে। এটা বানাতে নাফিস ব্যবহার করেছে এইচসি-এসআর০৪ ও এমএইচ-বি সেন্সর। মাদারবোর্ড হিসেবে আছে আরদুইনো-ইউএনও। প্রথমে ‘সোনার’ সেন্সর দুটি ব্যবহারকারীর হাতের অবস্থান বের করবে। সেন্সরগুলো একটি তরঙ্গ পাঠাতে থাকবে হাতে। সেটা আবার প্রতিধ্বনি তৈরি করে। এই প্রতিধ্বনির সময়ের ওপর নির্ভর করে তৈরি হয় নানা প্যাটার্ন তথা বিন্যাস। একেক প্যাটার্নের সঙ্গে মিল করে দেওয়া যায় একেক কমান্ড। এভাবেই মোশন সেন্সর কাস্টমাইজেশন করেছে নাফিস। এটা নিয়ে পরে আরো বড় কিছু করার ইচ্ছা আছে ওর।
ফটোগ্রাফিও তার বড় শখ। আর এর জন্য ক্যামরার খুঁটিনাটিও তার নখদর্পণে। যান্ত্রিক পরিবর্তন ঘটিয়ে ক্যামেরায় এমন এক সিস্টেম সেট করেছে, যা দিয়ে নির্দিষ্ট সময় বিরতিতে দীর্ঘ সময় ছবি তুলতে পারা যায়। এটা ক্যামেরার প্রচলিত টাইমল্যাপস মোডের একটি কাস্টমাইজেশন রূপ। জেস্টার কন্ট্রোলারের মতো এতেও একই ধরনের সেন্সর ও বোর্ড ব্যবহার করেছে নাফিস। নাফিস জানাল, ‘প্রথমে একটি আইআর রিসিভার ব্যবহার করে ক্যামেরা রিমোটের সিগনাল ডিকোড করি। তারপর রিমোটের শাটার ক্লিকের কোডটাকে বদলে দিই। এতে ওই সিগনাল নির্দিষ্ট সময় পর পর ব্রডকাস্ট হয়। তারপর হার্ডওয়্যারে নতুন অ্যালগরিদম আপলোড করলেই কাজ হয়ে যায়। ’
নাফিস ও তার কাজ নিয়ে তার স্কুলের আইসিটি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এখন ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়ে অনেকে অনেক কিছু বানায়। অনেকে আবার হুবহু কপি করে। তবে কেউ আছে একটা কিছু দেখে পরে নিজের মতো করে কিছু বানিয়ে ফেলছে। তবে নাফিসের প্রজেক্টগুলো আলাদা। আমার মনে হয় না, ওর মতো করে কেউ এগুলো আগে করতে পেরেছে। ’
থ্রিডি মডেলিং সফটওয়্যার ব্যবহার করে নাফিসের বানানো গাড়ির নকশা
নাফিসের একাডেমিক ফলাফল নিয়ে বললেন, ‘বাইরের অনেক বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও দেখা যায়, শিক্ষার্থী নির্বাচন করে নির্দিষ্ট বিষয়ে শিক্ষার্থীর দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে। আমি মনে করি না, ওর জিপিএ পাঁচহীন ফল তার ক্যারিয়ারে কোনো প্রভাব ফেলবে। ’
এদিকে গাড়িও ভালো লাগে নাফিসের। নিজের মতো করে গাড়ির নকশাও করে অবসরে। গণিতেও দখল তার। বাংলাদেশ ম্যাথ অলম্পিয়াড ২০১৫ ও ২০১৭-তে চট্টগ্রাম বিভাগে প্রথম রানার্স-আপ সে। কাঁচা নয় পদার্থবিজ্ঞানেও। বাংলাদেশ ফিজিকস অলিম্পিয়াড ২০১৫-তে সে বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম ও জাতীয় পর্যায়ে অষ্টম হয়েছে। বাদ যায়নি জ্যোতির্বিজ্ঞান। বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমি ও অ্যাস্ট্রোফিজিকস অলিম্পিয়াড ২০১৭-তেও প্রথম ১০ জনে ছিল তার নাম। প্রগ্রামিংয়েও সব্যসাচী। জাতীয় ও বিভাগীয় পর্যায়সহ প্রগ্রামিংয়ে রয়েছে সাতটি পুরস্কার। পাকা হাত আঁকাআঁকিতেও। ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম বর্ণমেলায় চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল।
খেলাধুলায় প্রিয় দাবা। ২০১৫ সালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ইনডোর গেমসে দাবায় চ্যাম্পিয়ন হয় সে। সম্প্রতি ব্রিটিশ কাউন্সিল আয়োজিত বিতর্ক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় তার দল।
ডিসেম্বরের জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি নিয়ে নাফিস জানাল, ‘গতবারের চেয়ে এবারের প্রস্তুতি ভালো। চেষ্টা করব দেশের জন্য ভালো কিছু করার। ’
নাফিসের পছন্দের বিষয় তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান। এ নিয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন তার। নাফিস জানায়, সবার মতো হয়তো তার মা-বাবাও চেয়েছিলেন তাঁদের ছেলে যেন গোল্ডেন ‘এ’ প্লাস পায়। কিন্তু একাডেমিক ফলের ক্ষেত্রে স্রোতের বিপরীতে চলা নাফিস তা পায়নি। এ নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথাও তার নেই। তার বাকি সব অর্জনে মা-বাবা দারুণ খুশি।